গান্ধার হল উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অঞ্চলের প্রাচীন নাম যা পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বতমালা এবং উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ দ্বারা বেষ্টিত। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই অঞ্চলটি জয় করেন এবং পরপর ইন্দো-গ্রীক রাজাদের সাথে শাস্ত্রীয় ঐতিহ্যের প্রবর্তন করেন যা পরবর্তী সাত শতাব্দীতে গান্ধার শৈল্পিক শব্দভান্ডারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
মৌর্য যুগের পরবর্তীকালে, বিশেষত শক-কুষাণ যুগে ভারতে যেসব শিল্পরীতির বিকাশ ঘটেছিল তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল গান্ধার শিল্পরীতি (Gandhara Art)।
সময়কাল
গান্ধার শিল্পের সময়কাল সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের আমলে গান্ধার শিল্পের চরম বিকাশ ঘটেছিল। ইতিহাসবিদ ড. নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন যে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এই শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল এবং পরবর্তী চারশো বছর এই রীতির অস্তিত্ব ছিল।
বৈশিষ্ট্য
অধিকাংশ পণ্ডিত ও শিল্পবিশারদ মনে করেন যে, গান্ধার শিল্পরীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় শিল্পরীতি। বৌদ্ধধর্মের বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে এই শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। তবে গান্ধার শিল্পরীতিতে গ্রিক ও রোমান শিল্পরীতিরও যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। গৌতম বুদ্ধের মূর্তির কুণ্ঠিত কেশ, পেশিবহুল বাহু, অর্ধনিমীলিত চক্ষু প্রভৃতিতে গ্রিক শিল্পরীতির যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ করা। পার্সি ব্রাউন গান্ধার শিল্পকে 'গ্রিক-বৌদ্ধ' বা 'Greaco-Buddhist' শিল্প বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী ও জন মার্শাল মনে করেন যে, এই শিল্পে গ্রিক প্রভাব অনেক বেশি ছিল। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন যে, গান্ধার শিল্পীর হাত দুটি গ্রিক দেশের হলেও তার অন্তর ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয় ।
অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
গান্ধার শিল্পের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এগুলি হল- গান্ধার শিল্প গ্রিক, রোমান ও ভারতীয় শিল্পরীতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। মূর্তি তৈরিতে পাথর, বালি, পোড়ামাটি, প্লাস্টার অফ প্যারিস, চুন প্রভৃতি ব্যবহার করা হত। মূর্তিতে সোনালি বা অন্য কোনো রঙের গাঢ় প্রলেপ দেওয়া হত। গৌতম বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণে গ্রিক দেবতা অ্যাপেলো, জিউস প্রমুখের অনুরূপ পেশিবহুল বাহু, কুষ্ণিত কেশ প্রভৃতির পাশাপাশি ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় লক্ষ করা যায়।
বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়
ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে গান্ধার অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এই শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। গান্ধার অঞ্চলকে কেন্দ্র করে নগরহর, বামিয়ান, বেগ্রাম, সোয়াট উপত্যকা, তক্ষশিলা, জালালাবাদ, ইউসুফজাই প্রভৃতি স্থানে এই শিল্পরীতির বিকাশ ঘটে। কনিষ্কের উদ্যোগে গান্ধার শিল্প ভারতের বাইরে ন, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, জাপান, কোরিয়া, মধ্য-এশিয়া প্রভৃতি স্থানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মূল্যায়ন
অধিকাংশ পণ্ডিত ও শিল্প-সমালোচক গাম্বার শিল্পের প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, ভারতের প্রথম সার্থক শিল্প ছিল গান্ধার শিল্প। ড. ত্রিপাঠী মনে করেন যে, গুপ্ত যুগেও গান্ধার শিল্পের লক্ষণীয় প্রভাব ছিল। তবে সৌন্দর্যের বিচারে এই শিল্প সাঁচি বা ভারহতের শিল্পের চেয়ে নিম্নমানের ছিল বলে মনে করা হয়। তাই ড. ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন যে, গান্ধার শিল্প ছিল 'যান্ত্রিক ও নিষ্প্রাণ'। ভারতীয় শিল্পের আধ্যাত্মিকতা এবং নমনীয়তাও এখানে লক্ষ করা যায় না। স্যার জন মার্শাল বলেছেন যে, গান্ধার শিল্প হল অনুকরণের অনুকরণ। তাঁর মতে, মূর্তির চাহিদা বৃদ্ধির ফলে অনেকটা ছাঁচে ঢালাইয়ের মতো করে যান্ত্রিকভাবে বুদ্ধমূর্তি নির্মিত হতে থাকে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, এই শিল্প ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেনি। তাই ভারতীয় শিল্পে এর প্রভাব ছিল না বললেই চলে।
শিল্পের রূপটি বৌদ্ধ মূর্তিচিত্রকে চিত্রিত করতে, ভাস্কর্য এবং ত্রাণগুলির মাধ্যমে বুদ্ধের জীবন ও শিক্ষাকে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটি বৌদ্ধধর্মের প্রসারে অবদান রাখে, এর নান্দনিক আবেদন এবং বাস্তবসম্মত চিত্রায়নের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষক ও ভক্তদের আকর্ষণ করে।
গান্ধার শিল্প নতুন কৌশল এবং উদ্ভাবন প্রবর্তন করে, পাশাপাশি প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির মূল্যবান ঐতিহাসিক ডকুমেন্টেশন প্রদান করে।